মাসিক চলা কালীন সময়ে মেয়েদের শারীরিক পুষ্টির চাহিদায় পরিবর্তন আসে। একজন মেয়ের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে মাসিক বা মেন্সট্রুয়াল বা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড। মাসিক চলাকালীন সময়টা প্রত্যেক মেয়ের জন্য বেশ কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। প্রত্যেক মেয়েকে সেই সময় কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে -তলপেটের অতিরিক্ত ব্যথা, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরানো, অ্যাসিডিটি, অরুচি, অত্যন্ত দুর্বলতা, খিটখিটে মেজাজ, অস্বস্তিবোধ ইত্যাদি। হরমোনের পরিবর্তন ও রক্তক্ষরণের কারণে মেয়েদের শরীরে অনেক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজের তারতম্য বা অভাব দেখা দিতে পারে। পিরিয়ডের দিনগুলোতে রক্তক্ষরণের কারণে শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়। আয়রনের ঘাটতি পূরণ , শরীরসুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে পুষ্টিকর খাবার অত্যন্ত জরুরী।
১। রক্ত পূরণে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
মাসিক চলাকালীন সময়ে অনেক রক্তক্ষরণ হলে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা হতে পারে। ঠিক সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে পরে অন্য জটিলতা হতে পারে। তাই এ সময় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। যেমন – কলিজা, ডিম, মাছ, মাংস, কচুশাক, লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা, খেজুর, আনার ইত্যাদি। আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের সাথে ভিটামিন- সি সমৃদ্ধ খাবার (যেমন- আমলকী , পেয়ারা, পেঁপে, আমড়া, লেবু, কাঁচামরিচ ইত্যাদি) খেলে আয়রনের শোষণ হতে সাহায্য হয়।
২। মাসিকের ব্যাথা কমাতে-
আদা বেশ উপকারী মাসিকের ব্যথা রোধের জন্য। আদা চা পান করলে এই সময় বেশ ভালো উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া কয়েক টুকরো আদা গরম পানিতে সেদ্ধ করে মধু/ চিনি সহযোগে দিনে তিন-চারবার পান করতে পারেন। পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর জন্য পেঁপে খাওয়া বেশ কার্যকর। তাছাড়া গরম পানির সেঁক নিতে পারেন, কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে পারেন।
৩। প্রোটিন ও তাপশক্তির চাহিদা পূরণে-
মাসিক চলাকালীন সময়ে ডাল, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকায় রাখুন। প্রোটিন আমাদের শরীরের ক্ষয়-পূরণ করে থাকে। পূর্ণ-শস্য জাতীয় খাবার ও সহজ পাচ্য খাবার এই সময় খাওয়া উচিৎ। কলা খেতে পারেন, মাসিকের সময় কলা নারী দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাতে সাহায্য করে। ফাইবার জাতীয় খাবার অন্ত্রের চলাচল নিয়মিত রাখে। আঁশজাতীয় খাবার দেহের হজমশক্তি উন্নত করবে। সামুদ্রিক মাছে থাকে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩, ভিটামিন, মিনারেল, ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো মাসিক চলাকালীন শরীরের ক্ষয় পূরণ করে এবং ব্যথা কমাতেও ভূমিকা রাখে।
৪। তরল ও পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে-
মাসিক চলাকালীন সময়ে রক্তের পাশাপাশি শরীর থেকে অনেক পানি বেরিয়ে যায়। এই অভাব পূরণ করতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। সুপ, ডাবের পানি, লেবু পানি, আদা-চা ইত্যাদি খাবার মেনুতে রাখতে পারেন।
৫। ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব পূরণে-
মাসিকের সময় মেয়েদের শরীর থেকে ভিটামিন ও খনিজ বের হয়ে যায় – এজন্য পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলে সুষম খাদ্যের তালিকা করে নেওয়াই উত্তম।
ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়ামযুক্ত খাবার মাথাব্যথা, পেটব্যাথা, পেশির টানের মতো লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে। মিষ্টি কুমড়ার বিচি, পূর্ণ-শস্য জাতীয় খাবার, কলা, ডাবের পানি, মিষ্টি আলু, বীজ, অ্যাভোকাডো ম্যাগনেশিয়াম-পটাশিয়ামের অন্যতম উৎস। কলা পটাশিয়ামের অন্যতম ভান্ডার, যা মাসিক চলা কালীন সময় আপনার বিষণ্ণতা দূর করে। মাসিক চলাকালীন ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। দুধ, দুধজাতীয় খাবার, পনির, টোফু, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ সয়া মিল্ক, কাঁটাযুক্ত মাছ ইত্যাদি। কারণ, ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার পেশিব্যথা, পেটব্যথা দূর করতে সাহায্য করে।
মাসিকের সময় ভিটামিন সি–যুক্ত ফল শরীরের জন্য অনেক উপকারী। শরীরে আয়রনের ঠিকমতো শোষণ ও যথাযথ কার্যকারিতার জন্য ভিটামিন সি প্রয়োজন। পেয়ারা, আমড়া, আমলকী, লেবু, মাল্টা, জলপাই, জাম্বুরা, পাকা টমেটো, কামরাঙা, পাকা পেঁপে, আনারস ইত্যাদিতে প্রচুর ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ভিটামিন বি১২ ও ভিটামিন বি৬ পেট ফাঁপা এবং মুড পরিবর্তন রোধ করে। ব্রকলি, টমেটো, লেবু, কমলা, কর্ণ, ডিম, আখরোট, চিয়া বীজ ইত্যাদি ভিটামিন বি১২ ও বি৬ সমৃদ্ধ খাবার। ভিটামিন-ই যুক্ত খাবার, যেমন-কুমড়ার বিচি, গমের বীজ, শুকনা ভাজা সূর্যমুখীর বীজসহ নানা ধরনের বীজ রাখতে পারেন খাবারের তালিকায়। এতে রয়েছে ভিটামিন-ই, যা ঋতুস্রাবের ব্যথা হ্রাস করে।
যে সকল খাবার খাওয়া যাবেনাঃ
* ক্যান্ডি এবং স্ন্যাকস – ক্যান্ডি ও স্ন্যাকস মন ভালো করে দিলেও এগুলো গ্যাস বা বুক জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে। এজন্য মাসিক চলাকালীন এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।
* ক্যাফেইন- অনেক গবেষণায় পাওয়া গেছে যে ক্যাফেইন মাসিকের সময়কাল বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়াও ক্যাফেইনের কারণে আরো অন্যান্য সমস্যার দেখা দিতে পারে।
* ঝাল খাবার-ঝাল খাবার পেটের ব্যথা এবং বুকের ভেতর জ্বালা-পোড়া বাড়িয়ে দিতে পারে।
* কোনো পানীয় নয়। কফি, কোলা ইত্যাদি গ্যাস বা বুক জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে।
* যাদের দুধ বা দুধে ল্যাকটোজ সহ্য হয়না , তারা দুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকবে। যা পেট ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়াও বমিবমি ভাব, মাথা ঘোরা
এধরনের সমস্যার ও সম্মুখীন হতে পারে।
স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক বিষয়ক ইউনিসেফের পরামর্শ-
কিশোরীদের মাসিক চলাকালীন করণীয় সম্পর্কে ইউনিসেফের প্রচারপত্রে বলা হয়েছে ভবিষ্যতের মানবসম্পদ হিসেবে কিশোরীদের মাসিক তথা প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে মাসিক সময়কালে করণীয় সম্পর্কে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো:
১. প্রয়োজনে বাবা-মা ও পরিবারের অন্য নারী সদস্যদের সাথে কথা বলা।
২. স্যানিটারি ন্যাপকিন বা পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা এবং অভিজ্ঞদের কাছে এর ব্যবহার বিধি জেনে নেয়া।
৩. মাসিকের সময় ব্যবহৃত পোশাক নোংরা পানিতে না ধোয়া, বরং সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধোয়া।
৪. মাসিকের কাপড় অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় শুকাতে না দিয়ে বরং পরিষ্কার জায়গায় রোদে শুকানো ও নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ করা।
৫. পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে দুধ,মাছ, মাংস, ডিম, শাক সবজি ও ফলমূল খেতে হবে। অন্য সময়ের তুলনায় বেশি খাবার খাওয়া।
৬. তলপেটের ব্যথার সময় বোতলে গরম পানি নিয়ে সেঁক দিলে আরাম পাওয়া যাবে।
৭. অতিরিক্ত ব্যথা বা সংরক্ষণ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৮. বিশ্রামে থাকতে হবে, তবে স্কুলে যাওয়া বা ঘরের কাজ করার মতো স্বাভাবিক কাজ করা অব্যাহত রাখা যাবে।
৯. মাসিকের সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু ব্যায়াম শরীর ও মনকে ভালো রাখতে পারে।
মাসিককে কেন্দ্র করে মেয়েদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে বিবেচনায় রাখা দরকার। এগুলো হলো:- পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, হাইজিন সম্পর্কে ধারণা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিন ও ভিটামিন নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের সহায়তা নেয়া।
পথ্য ও পুষ্টিবিদ- সৈয়দা শিরিনা (স্মৃতি)
সিনিয়র ডায়েটিশিয়ান ও ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট
এবং বিভাগীয় প্রধান, বিআরবি হসপিটালস লিমিটেড, ঢাকা।
প্রাক্তন ডায়েটিশিয়ান, এপোলো হসপিটালস ঢাকা।